মুষলধারে বৃষ্টি ঔরঙ্গাবাদের কাছে। ফ্ল্যাগ, ফেস্টুন ইতস্তত উড়ছে দমকা হাওয়ায়। একজন ছাত্র কমরেড দৌড়ে আসছে। তার মাথাটা ঢাকা একটা ব্যানার দিয়ে। ব্যানারে একজনের ছবি জ্বলজ্বল করছে। যে ছবি মুহূর্তে শিহরণ তুলে দেয় ছাত্র-যুবদের মিছিলে। যাঁর লড়াই ও আত্মত্যাগ আমাদের পথ চলতে শেখায়। যেকোনো দুর্যোগে, যেকোনো শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমরা সবসময় তাঁরই শরণাপন্ন হই, শরণাপন্ন হই তার মতাদর্শের। ব্যানারে ছবিটা ছিল শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং-এর।
জেনারেল ডায়ার যেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে ফায়ার় কল দিয়েছিল সেদিন বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল প্রেয়সী। তারপর গোটা দেশটাকেই নিজের করে নিয়েছিল সর্দার উধম সিং। জেনারেল ডায়ারকে সামনে থেকে গুলি করে বদলা নিয়েছিল। আসলে এই কথাগুলো মনে পড়ছে খুব। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে “আজাদি কা অমৃত মহোৎসব” চলছে। এই ৭৫ বছর উদ্যাপন তথাকথিত দেশভক্ত নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী ও তার চ্যালাচামুণ্ডারা যেভাবে করবে আমরা সেভাবে করবো না সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের কাছে ভগৎ সিং, উধম সিং-রা আছে। ওদের কাছে সাভাকারের মুচলেকা ছাড়া কিছুই নেই।
গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ধর্মের জিগির তুলে ক্ষমতায় এসেছে যোগী আদিত্যনাথ। তারপর গোটা রাজ্যে শুরু হয়ে গেছে হিন্দুত্বের এজেন্ডার গ্রাউন্ড লেভেল ইমপ্লিমেন্টেশন। গোরক্ষপুরের ভক্তগণ যোগীজিকে ভালোবেসে নাম দিয়েছে বুলডোজার বাবা। আর গোরক্ষপুর থেকে শুরু করে গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে হিন্দুত্বের বুলডোজার ছোটাচ্ছে যোগী আদিত্যনাথ ও বিজেপি। আপনি কি খাবেন কি খাবেন না, আপনার সিলেবাসে কি থাকবে কি থাকবে না, আপনি কার উপাসনা করবেন ও করবেন না - সব ঠিক করে দেবে বাবাজী ও তার দলবল। আর আপনি যদি দলিত হয়ে গেলেন তো কথাই নেই। শুধু ছুঁয়ে দেওয়ার অপরাধে খুন হয়ে যাবেন আপনি। ধর্মে মুসলমান হলে ফ্রিজে মাংস রাখার অপরাধে খুন হয়ে যাবেন আপনি। প্রতিবাদ করলে পিষে চলে যাবে মন্ত্রীর ছেলের গাড়ি। আপনি রেপ হয়ে যাবেন যখন তখন, তারপর প্রশাসন এসে পুড়িয়ে দেবে কোনো না কোনো ধানক্ষেতে এরকমই বুলডোজার বাবার রাজ্য। আসলে এই বুলডোজার কারোর নাম না, একটা সংস্কৃতি। গোটা দেশে এই সংস্কৃতি তৈরি করতে চাইছে RSS-BIP।
ত্রিপুরায় ক্ষমতা দখলের পরই বিপ্লব দেবের সরকার বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছিল লেনিন মুর্তি। সেই বিলোনিয়ায় গিয়েছিলাম ক-দিন আগেই। বিপ্লব দেব ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে চলে গেছে। হাজার হাজার ছাত্র-যুবর স্লোগানে, বিশ্বাসে,
প্রতিরোধে জেগে আছে লেনিন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছাত্র জাঠা শুরু হয়েছিল ত্রিপুরা থেকে। শিক্ষা বাঁচানোর দাবি, সংবিধান বাঁচানোর দাবি ও দেশ বাঁচানোর দাবি নিয়ে। ত্রিপুরার বিজেপি সরকার পুলিশ নামিয়ে সেই জাঠা আটকেছিল। কমরেডদের জেদের কাছে ওইসব ব্যারিকেড ফুৎকারে উড়ে গেছে। লেনিনের বাচ্চাদের রক্তের তেজ দেখেছে ত্রিপুরা। কোনো বুলডোজার দিয়ে কোনো আন্দোলনকেই শেষ করা যায়নি। বুলডোজারের গায়ে বিজেপি সরকারের এক্সপায়ারি ডেট লিখে দিয়েছে ছাত্র-যুবরা।
বিজেপি সবসময়ই গরীব মানুষের শত্রু। দিল্লীর বুকে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবে একটা গোটা বস্তি। বুলডোজার প্রস্তত। ভাঙাও হয়েছে খানিক। কোর্ট থেকে স্টে-অর্ডার নিয়ে বুলডোজারের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেল বৃন্দা কারাত। আমাদের আদর্শ, আমাদের বোঝাপড়া এটাই শিখিয়েছে আমাদের। বৃন্দা কারাতরা গরীব মানুষের পার্টি করেন। গরীব মানুষের স্বার্থে বুলডোজারের সামনে আঙুল তুলে পাল্টা দিতে প্রস্তুত থাকেন সবসময়ই।
এই বুলভোজারের সংস্কৃতি হালফিলে শুরু হয়েছে এরকম নয়। আগেও নানানভাবে বিজেপি সরকার চেষ্টা করে গেছে সবকিছু গুঁড়িয়ে দিতে। কালা কৃষি কানুন এনে কৃষকদের অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কৃষকরা পাল্টা দিয়েছে, মোদী
সরকারের শাটার ডাউন করে দিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার উপর বুলডোজার চালিয়েছে দেশের সরকার। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির নামে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার বুনিয়াদটা ধ্বংস করে দেওয়ার চক্করে আছে মোদী এন্ড কোং। ফেলো কড়ি মাখো তেলের মতো আদানি-আম্বানির ইউনিভার্সিটি হবে আর গরীব ঘরের ছেলেমেয়েরা পয়সার অভাবে লেখাপড়া করতে পারবে না। গোটা দেশজুড়ে সস্তা শ্রমিক তৈরি করার কারখানা বানাতে চাইছে বিজেপির সরকার। আপনি কখনও শুনেছেন যে দেশের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলে? আমাদের দেশের বিজেপি সরকার এই ন্যাক্কারজনক কাজটাও করে ফেলার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। 'অগ্নিবীর' প্রকল্পের নামে কন্ট্রাকচুয়াল সেনা নিয়োগ দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর বুলডোজার চালাচ্ছে মোদী সরকার। মূল্যবৃদ্ধির বুলডোজার, বেকারত্বের বুলডোজার, মিথ্যে কেস দিয়ে হয়রানির বুলডোজার এসব তো ছেড়েই দিন। জিনিসের দাম কেন বাড়ছে, কেন চাকরি হচ্ছে না - এসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে আপনার সামনে মিডিয়ার বুলডোজার রেডি আছে।
আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গের দিকে চোখ রাখেন তাহলে দেখবেন দুর্নীতির বুলডোজার দিয়ে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ভেঙে ফেলেছে তৃণমূলের সরকার। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি পরতে পরতে দুর্নীতি। যারা কষ্ট করে লেখাপড়া করে, পরীক্ষায় পাশ করে স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি করতে চেয়েছিল তারা রাস্তায় বসে আছে প্রায় ৬০০ দিন ধরে। তাদের চাকরি চুরি করে নিয়েছে তৃণমূলের মাতব্বররা। তারপর লক্ষ লক্ষ টাকায় অযোগ্য লোকজনকে সেই চাকরি বিক্রি করা হয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাসকে লুটের আখড়া বানিয়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াকে মরসুমি ব্যবসায় পরিণত করেছে তারা। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধ ভাবে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করায় পুলিশ পাঠিয়ে খুন করেছে আনিশ খানকে। চাকরি চাইতে গিয়েছিল বলে খুন করেছে মইদুল মিদ্যাকে।
আমরা যারা একটু একটু করে প্রতিদিন স্বপ্ন সাজাই একটা সুন্দর সকালের, তাদের জন্য একটা কঠিন সময় এখন। একটা গাঢ় অদ্ধকারময় রাত পেরোতে হচ্ছে আমাদের। আসলে আমাদের হেঁটে যাওয়া যখন আলোর সন্ধানে তখন এ'পথ
আমাদের পেরোতেই হবে। ওদের বুলডোচির জধারাতরেই হবে। ওরা ভাঙবে, আমরা তামিলনাড়ুর আদিবাসী গ্রাম থেকে গড়ে তুলবো আগামীর আন্দোলন। ওরা গুঁড়িয়ে দিতে চাইবে, আমরা বিলোনিয়ায় পিকেটিং করবো ডান্ডা ও ঝান্ডা কাঁধে। ওরা গুলিয়ে দিতে চাইবে, আমরা মগজের দখল নেব আজাদ ময়দান পেরিয়ে সবরমতী পর্যন্ত। ওরা লুট করে নিতে চাইবে, আমরা ধর্মতলা মুড়ে দেব কালো মাথায়। সুদীপ্ত, সইফুদ্দিন, মইদুল থেকে আনিশ খান - কালো মাথা শেষ হবে না। লড়াইয়ের তীব্রতাও শেষ হবে না।
ভগৎ সিং বলেছিলেন - বোবা মানুষকে শোনানোর জন্য খুব জোরে চিৎকার করতে হয়। ভগৎ সিং শুধু বলেননি, করেও দেখিয়েছিলেন। তাই আজও ঔরঙ্গাবাদ থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্যাম্পাসে, প্রতিটা মিছিলে, প্রতিটা জাগরণে চির জাগরুক থাকে ভগৎ সিং-রা। প্রতিটা প্রেমে, প্রতিটা পাশে হাঁটায় ঠিক পাশে হেঁটে চলে উধম সিং-রা। আমি আশুতোষ কলেজে পড়তাম। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে সিনিয়রদের মুখে শুনে একছটা িপোসল্টাারেরম কথা -
আমাদের প্রতিটা দিন - শপথে কঠিন
আমাদের প্রতিটা প্রেম - হোঁচট খেয়ে জেদি
আমাদের প্রতিটা রাত, গরম ভাত - সার্বজনীন
আমাদের প্রতিটা উঠোন - উদ্ধত শহীদ বেদি।
আমাদের জাঠা প্রায় গোটা ভারতবর্ষ পেরিয়েছে। নানান অভিজ্ঞতা কুড়িয়েছি আমরাও। এই বুলডোজারের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের গল্প ছড়িয়ে দিয়েছি সর্বত্র। বুলডোজারে চিড় ধরানোর শপথ ধ্বনিত হয়েছে মাঠে, ময়দানে, মহল্লায়। এই জাঠা পরিক্রমা করতে করতেই একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। ১লা সেপ্টেম্বর গিয়েছিলাম শহীদ আনিশ খানের বাড়িতে। আনিশের বাবা সালেম খান। চোয়াল চাপা লড়াই করছেন আনিশের আব্বু। শিরদাঁড়া টানটান, গলায় সাহস নিয়ে শুধু বললেন - “আনিশ থাকলে তোমাদের সাথে কাল মিছিলে হাঁটতো”। তখন রূপকথা লেখা হয়েছিল নাকি জানিনা, কিন্তু নিশ্চয়ই তখন কেউ কাঁচাপাকা হাতে দেওয়ালে লিখে দিয়েছিল - “They may kill me, but the cannot kill my ideas. They can crush my body, but they will not be able to crush my spirit.”
ভগৎ সিং বলেছিলেন। ঔরঙ্গাবাদের ছেলেটাও হয়তো জানতো। তাই প্রবল বর্ষণে আঁকড়ে ধরেছিল ভগৎ সিং-কে। ছেলেটা সালেম খানকেও নিশ্চয়ই চিনবে। আর সিনা টান করে বুলডোজারের রাজনীতির মুখোমুখি দাঁড়াবে। একদম মুখোমুখি। যেখানে আমি, আমার আরও অনেক কমরেড, সালেম খান, রাধিকা ভেমুলারাও থাকবো। আপনার আমন্ত্রণ রইলো...